২৫তম কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা দিবস: একটি সামাজিক স্বাস্থ্য বিপ্লবের ইতিহাস। স্বাস্থ্য সকলের মৌলিক অধিকার, আর কমিউনিটি ক্লিনিক তারই বাস্তব রূপায়ণ। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় কমিউনিটি ক্লিনিকের অর্জন, গ্রামীণ জনগণের মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন। কমিউনিটি ক্লিনিক” (Community Clinic) ও “সিএইচসিপি” (CHCP – Community Health Care Provider) বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্বাস্থ্যই সম্পদ, কমিউনিটি ক্লিনিকই তার বাহন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ইতিহাসে কমিউনিটি ক্লিনিক এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১৯৯৮ সালের ২৬ এপ্রিল এই কর্মসূচির সূচনা হয়।
আজ ২৫ বছর পূর্ণ করে কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়ে একটি সামাজিক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে, ১৯৯৮ সালের ২৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে রচিত হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়। যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে গ্রামবাংলার স্বাস্থ্যসেবার প্রাণকেন্দ্র। আজ এই প্রতিষ্ঠান দিবসে আমরা স্মরণ করছি সেই অবিস্মরণীয় যাত্রাকে, যে যাত্রা এনেছে অসংখ্য মানুষের জীবনে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা।
এই পঁচিশ বছরে কমিউনিটি ক্লিনিক আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে সহজ সমাধান বদলে দিতে পারে সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। গর্ভবতী মায়ের প্রসবপূর্ব যত্ন থেকে শুরু করে নবজাতকের টিকা, শিশুর পুষ্টি পরামর্শ থেকে বয়স্কদের রক্তচাপ পরীক্ষা – সবই এখন পাওয়া যায় স্থানীয় ক্লিনিকে। বিশেষ করে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে এই ক্লিনিকগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রত্যন্ত অঞ্চল, হাওর-বাওড় কিংবা পার্বত্য এলাকায় যেখানে সরকারি হাসপাতাল অনেক দূরে, সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকই হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা।
তবে এই সাফল্যের পথটি মসৃণ ছিল না। শুরুতে ছিল সংশয়, ছিল সম্পদের অভাব। কখনো ঔষধের অভাবে, কখনো প্রশিক্ষিত কর্মীর স্বল্পতায় ভুগতে হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে জনগণের আস্থা অর্জন করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। আজ একজন গ্রাম্য কৃষাণী থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত সকলেই জানে, অসুখ-বিসুখে প্রথমে যেতে হবে স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকে।
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কমিউনিটি ক্লিনিককে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে রেকর্ড ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন সেবার সম্প্রসারণ এবং আরও বেশি প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে এই সেবাকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সাথে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে এই ক্লিনিকগুলো হয়ে উঠবে প্রকৃত অর্থেই কমিউনিটির নিজস্ব সম্পদ।
২৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক – প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক যেন হয়ে ওঠে স্বাস্থ্য সচেতনতার আলোকবর্তিকা। কারণ, সুস্থ জাতিই পারে গড়ে তুলতে সমৃদ্ধ দেশ। কমিউনিটি ক্লিনিকের এই যাত্রা শুধু স্বাস্থ্যখাতেরই নয়, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আগামী দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকুক, এই হোক আমাদের সকলের কামনা।
কমিউনিটি ক্লিনিকের অর্জন, গ্রামীণ জনগণের মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন
কমিউনিটি ক্লিনিক: উদ্ভব ও লক্ষ্যঃ
১৯৯৬ সালে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের কাছে সহজলভ্য করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প চালু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল।
- ১. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ।
- ২. মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা।
- ৩. সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা প্রদান।
- ৪. সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা।
অর্জন ও প্রভাবঃ
- Maternal ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস: কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে টিকা প্রদান, প্রসবপূর্ব যত্ন ও পুষ্টি পরামর্শ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
- সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ: ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে ক্লিনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
- স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী (সিএইচসিপি) ও স্বেচ্ছাসেবকরা গর্ভাবস্থা, স্যানিটেশন, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষা দিচ্ছেন।
- দূরবর্তী অঞ্চলে সেবা: হাওর, চর ও পার্বত্য এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র আশ্রয়স্থল।
চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের পথ: যদিও কমিউনিটি ক্লিনিক সফল, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান:
- ঔষধ ও সরঞ্জামের স্বল্পতা।
- কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব।
- ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা।
এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন—
- অধিক বাজেট বরাদ্দ।
- প্রযুক্তির ব্যবহার (টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল ডাটাবেস)।
- স্থানীয় সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি।
কমিউনিটি ক্লিনিক শুধু একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের সামষ্টিক উন্নয়নের প্রতীক। ২৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার করা উচিত— এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, যাতে সিএইচসিপিগণ Sustainable Development Goals (SDGs) অর্জনে অবদান রাখতে পারে।
কমিউনিটি ক্লিনিক উল্লেখযোগ্য সেবাসমূহ :
- প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা
- গর্ভবতী ও প্রসূতির স্বাস্থ্য সেবা
- নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা
- পরিবার পরিকল্পনা সেবা
- পুষ্টি সেবা
- ইপিআই
- সাধারণ রোগ ও জখমের চিকিৎসা সেবা
- অসংক্রামক রোগ সনাক্তকরণ ও রেফারেল
- কিশোর-কিশোরী ও নববিবাহিত দম্পতিদের সেবা
- কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও টিকা প্রদানে সহযোগিতা প্রদান
- স্তন ও জরায়ু মুখে ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভায়া স্ক্রিনিং, রেজিষ্ট্রেশন করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেরণ
- জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধীকরণ
- জরুরি ও জটিল রোগীর রেফারেল সেবা
- স্বাভাবিক প্রসব (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)
- কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মএলাকার জনগণকে খানাভিত্তিক অনলাইন রেজিষ্ট্রেশন ও হেলথ আইডি কার্ড প্রদান
- অন্যান্য সেবা
কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাদাতা ও সেবাদানের সময় ও প্রক্রিয়া:
১. সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত সপ্তাহে ৬ দিন (শনিবার হতে বৃহস্পতিবার) সকাল ৯:০০ টা হতে বিকাল ৩:০০ টা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক খোলা থাকে।
২. কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) প্রতি কর্মদিবসে কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবাপ্রদান করেন এবং সিএইচসিপি এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রত্যেক সপ্তাহে নূন্যতম ৩ দিন করে (পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে) কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করেন।
৩. কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য নির্ধারিত সময়ে কমিউনিটি ক্লিনিক খোলা রাখতে হবে। মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীর মধ্যে কে কবে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাপ্রদানে সহায়তা করবেন তা যৌথভাবে পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার অনুমোদন সাপেক্ষে বাস্তবায়িত হবে। অনুমোদিত কর্মসূচির ১টি কপি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবর প্রেরণ করতে হবে এবং ১টি কপি কমিউনিটি ক্লিনিকে টানিয়ে রাখতে হবে।
৪. যে সকল এলাকায় পুষ্টিকর্মী আছে তাঁরা নিয়ম অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিক এলাকার নির্ধারিত কার্যক্রম কমিউনিটি ক্লিনিকে থেকে করবেন।
৫. কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের সদস্যবৃন্দ কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা প্রদান ও মান উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করবেন।
৬. এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন- এমন গ্রাম্য চিকিৎসক, দাই এবং অন্যান্য সেবাদানকারী, মাদার সাপোর্ট গ্রুপ ও এনজিও কর্মীদেরকে UHFPO, UFPO & MOMCH কমিউনিটি ক্লিনিকের সাথে সম্পৃক্ত করে তাঁদের সেবা নিশ্চিত করবেন।