গুইসাপের নামের সঙ্গে সাপ কথাটি যুক্ত থাকলেও আসলে এটি কোনো সাপ নয়, এটি মূলত টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ প্রাণী। গুইসাপ শব্দটি মূলত এসেছে গোসাপ শব্দ থেকে ৷ গো অর্থ গোরু ৷ গোরুর মতো চারটি পা এবং সাপের মতো জিহ্বা চেড়া হওয়ার কারণে গোসাপ বলা হয় ৷ পশ্চিমবঙ্গের গোসাপ বাংলাদেশে এসে গুইসাপ হয়ে গেছে। এরা সাঁতার কাটতে এবং গাছে উঠতে পটু। এদের দাঁত লম্বা, তীক্ষ্ণ । এরা উভচর প্রাণী। এরা oviparous পদ্ধতিতে বাচ্চা জন্ম দেয় অর্থাৎ ডিম পারে।গুইসাপ ডিম মাটি দিয়ে ঢেকে রাখে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সময়ের মধ্যে মেটিং করে ১০-৪০ টি ডিম দেয় এবং বাচ্চা ফুটায়। এরা ৩০ বছর পর্যন্ত বাচতে পারে।
- নামঃ- গুইসাপ বা গোসাপ।
- ইংরেজি নামঃ- Monitor Lizard.
- বৈজ্ঞানিক নামঃ- Varanus.
- প্রচলিত নামঃ- এলাকাভেদে গোসাপ, গোধা, গোধিকা,গুই, গুইল, গুল, গুলসাপ ইত্যাদি বলে থাকে।
- বিষের ধরনঃ- আগে এদেরকে নির্বিষ ধরা হলেও সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী ক্ষতিকর লালার পাশাপাশি এরা মৃদু বিষধরও ৷ গুইসাপের মুখে বা লালায় “ক্লোস্ট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন্স” নামক ক্ষতিকর জীবানু থাকে ।
- খাদ্য তালিকাঃ- সাধারণত বিষধর সাপ ও সাপের ডিম, মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, শামুক, পচা-গলা প্রাণিদেহ,ধানক্ষেতের ইঁদুর, ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় ইত্যাদি খায়।
- বাসস্থান ও অঞ্চলঃ- এরা সাধারণত মাটির গর্ত, গাছের কোটর, পুরোনো দেয়ালের ফাটল, পরিত্যক্ত ইটভাটায় ও কবরস্থানে পুরাতন কবরের ভিতরে বসবাস করে। বাংলাদেশের সর্বত্র একে দেখতে পাওয়া যায়।
গুইসাপ বা গোসাপ | Varanus | Monitor Lizard
এরা ইদুর ও মরা পচা প্রানীদেহ খেয়ে কৃষক ও পরিবেশ দূষনরোধে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা রাখে। তাই এদেরকে “কৃষকের বন্ধু ও পরিবেশের পরিচ্ছন্ন কর্মী” বলা হয়। গুইসাপ আমাদের প্রকৃতির একটা বিপন্ন সৌন্দর্য ৷ বিপন্ন বলার কারণ, গত ১ দশকে এদের পরিমাণ ভয়াবহ আকারে কমেছে ৷ একটা কথা প্রচলিত আছে যে, গুইসাপ থুথু দেয়, যেটা গায়ে লাগলে পচে যায় ৷ আবার গুইসাপ লেজ দিয়ে বাড়ি মারলেও সেখানে পচে যায় ৷ প্রথমত গুইসাপ থুথু দিতে পারেনা ৷ এটা সম্পুর্নরুপে কুসংস্কার। এদের লেজের পেশি অনেক শক্তিশালী ফলে লেজ দিয়ে বাড়ি মারলে কেটে যাবে ।
পরিবেশে শিকারের অভাবের কারণে হাঁস-মুরগির ডিম, বাচ্চা ইত্যাদি খায় বলে মানুষের হাতে মারা পড়ে এরা ৷ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন গুইসাপের মাংস খেয়ে থাকে। ওঝা বা কবিরাজ গুইসাপের চামড়া দিয়ে বিভিন্ন রোগের তেল বানায় ( যা অদৌ কার্যকরী নয়) । ফলে দিন দিন এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এরা হাঁসমুরগি খেয়ে সামান্য লোকসান করলেও পক্ষান্তরে বিষধর সাপ, সাপের ডিম, ইঁদুর ইত্যাদি খেয়ে উপকারও করে ৷ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও এদের ভূমিকা অনেক বেশি ৷
গুইসাপের চামড়া মোটা ,মজবুত, উন্নতমানের হওয়ায় বিশ্ববাজারে এর বেশ চাহিদা রয়েছে। এর চামড়া দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ, ম্যানি ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি চামড়ার সরঞ্জাম তৈরি করা হয়। ১৯৭৮ সালে দেশে ব্যাপক সংখ্যাক গুইসাপ গনহারে হত্যা করা হয়। কারন ১৯৭৮-৭৯ সালে দেশ থেকে ৫১ লাখ ৪৩ হাজার টাকার গুইসাপের চামড়া রফতানি হয়েছে। পরিবেশগত গুরুত্ব ও ক্ষতির মাত্রা অনুধাবন করে ১৯৯০ সালে গুইসাপ হত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাংলাদেশ সরকার। ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়ন (IUCN) গুইসাপকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। IUCN কালো গুইসাপকে সংকটাপন্ন এবং সোনা গুইসাপ ও রামগদি গুইসাপকে বিপন্নের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
গুইসাপের তিনটি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়ঃ
- (i) Golden monitor (Varanus flavescens) এর বাংলা নাম স্বর্ণগোধিকা, সোনাগুই। বাংলাদেশে প্রাপ্ত গুইসাপের প্রজাতিগুলোর মধ্যে এটা সবচেয়ে দুর্লভ এবং ছোটো। দেশের পাহাড়ি এলাকায় সোনাগুই বেশি দেখা যায়।
- (ii) Bengal monitor(Varanus bengalensis) বাংলা নাম কালাগুই, কৃষ্ণগোধিকা, স্থলগোধিকা, বাংলাগুই ৷ বাংলাদেশের গুইসাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমন এটা ৷ বাংলাদেশের সর্বত্র এর বিচরন। কালো গুইসাপ ৫ ফুটের মতো লম্বা হয়ে থাকে।
- (iii) Asian water monitor/Ring monitor(Varanus slavator) বাংলা নাম রামগদি, রামগুই, বড়োগুই ইত্যাদি।৷ এরা শুধু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো গুইসাপই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা লিজার্ড এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম গুইসাপ । রামগদি উপকূলীয় অঞ্চল, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। এটি লম্বায় গড়ে ৭ থেকে ৯ ফুট পর্যন্ত এবং ওজন প্রায় ২৫ কেজিরও বেশি হতে পারে। একটি পুর্নবয়স্ক রামগদি সর্বোচ্চ ১১ ফুট লম্বা হতে পারে।
চিকিৎসাঃ গুইসাপের মুখে বা লালায় “ক্লোস্ট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন্স” নামক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকায় কামড় দিলে তা মাংস পচিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়।এবং গ্যাংগ্রীন হয়। এদের লেজের পেশি অনেক শক্তিশালী ও ত্রিকোনা হওয়ায় লেজ দিয়ে বাড়ি মারলে কেটে যায়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার কারণে লেজে ময়লা থাকে ৷ ফলে ক্ষতস্থানে লেগে ইনফেকশন হতে পারে। গুইসাপ কামড় দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ৷
নোটঃ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ৯৬ পৃষ্ঠা, তফসিল ২ অনুযায়ী গুইসাপ সংরক্ষিত প্রাণী। এদেরকে ধরা, মারা, খাওয়া, কেনা-বেচা, পোষা, বহন করা বেআইনি৷ অযথা সাপ মারা হতে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন দিন অথবা বনবিভাগের সাথে যোগাযোগ করুন।